দেশজুড়ে

সাঁওতাল হত্যার বিচার চাইলেন আদিবাসী-বাঙালী ও মানবাধিকার সংগঠনের নেতারা

ডেস্ক রিপোর্ট

৬ নভেম্বর ২০২৩ , ২:১৩:৩৪ প্রিন্ট সংস্করণ

জেলা প্রতিনিধি, গাইবান্ধা:
সাত বছরেও গাইবান্ধার তিন সাঁওতাল হত্যার বিচার হয়নি উল্লেখ করে বিভিন্ন আদিবাসী-বাঙালী ও মানবাধিকার সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বলেছেন, ‘২০১৬ সালের ৬ নভেম্বরের ঘটনার পর থেকে নির্যাতনের শিকার আদিবাসী সাঁওতালরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। গৃহহীন হয়ে তারা অসহায় দিনাতিপাত করছে। আহতরা চিকিৎসার অভাবে কেউ পঙ্গু, কেউ শরীরে গুলির স্পিøন্টার নিয়ে অসহ্য যন্ত্রনায় কর্মক্ষমতা হারিয়ে জীবন অতিবাহিত করছে। নভেম্বরের ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে নানা আশ্বাসের বাণী শোনালেও তার কোনটিই আজও বাস্তবায়ন হয়নি।’
সোমবার (০৬ নভেম্বর) দুপুরে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাটামোড় এলাকায় ‘সাঁওতাল হত্যা দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে বক্তারা এসব কথা বলেন।
সাঁওতাল হত্যার বিচার, আসামিদের গ্রেপ্তার, গুলিতে আহত সাঁওতাল, বাড়ীঘরে লুটপাট, অগ্নিসংযোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতালদের ক্ষতিপূরণ ও সাঁওতালদের রক্তভেজা তিন ফসলি জমিতে ইপিজেড নির্মাণ বন্ধের দাবি জানিয়ে সমাবেশে বক্তারা বলেন, ‘যে কোন এলাকার উন্নয়নে ইপিজেড স্থাপন, সেই এলাকার মানুষের জন্য অবশ্যই সুখের খবর। কিন্তু সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের আদিবাসী ও বাঙালিদের বাপ-দাদার জমিতে সেখানকার ওয়ারিশগণের সাথে কোন ধরনের স্বাধীন, পূর্বাবহিত সম্মতি ছাড়াই ইপিজেড স্থাপনের ঘোষণা আদিবাসী-বাঙালি জনগণকে হতাশ করেছে।’
এদিন সকাল থেকে নানান আয়োজনে গোবিন্দগঞ্জে ‘সাঁওতাল হত্যা দিবস’ পালিত হয়েছে। সকাল আটটায় গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার জয়পুর গ্রামে নির্মিত অস্থায়ী শহীদবেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করা হয়। সকাল নয়টায় সাঁওতালপল্লি মাদারপুর ও জয়পুর গ্রাম থেকে সাঁওতালদের ঐতিহ্য তির-ধনুক, কালো পতাকা, ব্যানার, বিভিন্ন দাবিদাওয়া সংবলিত ফেস্টুন নিয়ে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি ১০ কিলোমিটার পথ প্রদক্ষিণ করে গোবিন্দগঞ্জ-দিনাজপুর সড়কের কাটামোড়ে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে বেলা সাড়ে ১১টায় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশের শুরুতে শহীদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর প্রতিবাদী সংগীত পরিবেশিত হয়।
তিন সাঁওতাল হত্যা, সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের জমিতে তোলা বাড়িঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগের বিচারের দাবিতে এসব কর্মসূচি পালিত হয়। সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), আদিবাসী-বাঙালী সংহতি পরিষদ, সামাজিক সংগ্রাম পরিষদ ও জনউদ্যোগ গাইবান্ধা যৌথভাবে এসব কর্মসূচি পালন করে।
সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য দেন, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন, আদিবাসী বাঙালি সংহতি পরিষদের আহ্বায়ক সিরাজুল ইসলাম বাবু, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নরেন পাহান, গাইবান্ধা সামাজিক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর কবীর তনু, বাসদ নেতা জয়নাল আবেদীন মুকুল, আদিবাসী নেতা বিমল খালকো, অগস্টিন মিনজী, আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদের সদর উপজেলা শাখার আহ্বায়ক গোলাম রব্বানী মুসা, সামাজিক সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব দীপন হাসান, মানবাধিকার কর্মী মনির হোসেন সুইট, আদিবাসী নেতা প্রিসিলা মুর্মু, সুফল হেমব্রম, গৌড় চন্দ্র পাহাড়ী, মাথিয়াস মার্ডি, বৃটিশ সরেন, তৃষ্ণা মুর্মু প্রমুখ।
বক্তারা বাগদা ফার্মের তিন ফসলি জমিতে ইপিজেড স্থাপনের প্রক্রিয়া বন্ধ করে জেলার অন্যত্র করা, চাষাবাদরত সাঁওতাল-বাঙালিদের সেচ সুবিধার জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান, সমতলের আদিবাসীদের ভূমি সংকট নিরসনে পৃথক ও স্বাধীন ভূমি কমিশন গঠনসহ সাত দফা বাস্তবায়নের দাবি করেন।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর সুগার মিল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা সাঁওতালদেরকে উচ্ছেদ করতে গেলে স্থানীয় প্রভাবশালী, পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের দফায় দফায় সংঘর্ষে ৩০ জন সাঁওতাল আহত হন। তাঁদের মধ্যে তিন সাঁওতাল মঙ্গল মার্ডি, রমেশ টুডু ও শ্যামল হেমব্রম মারা যান। এসব ঘটনায় সাঁওতালদের পক্ষে স্বপন মুরমু বাদি হয়ে ওই বছরের ১৬ নভেম্বর ৬০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি দেখিয়ে মামলা করেন। এছাড়া ওই সালের ২৬ নভেম্বর থোমাস হেমব্রম বাদি হয়ে তৎকালীন গাইবান্ধা- ৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ, রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল আওয়াল, তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আব্দুল হান্নান, খামারের ব্যবস্থাপক আব্দুল মজিদ, সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাকিল আকন্দ বুলবুল ও কাটাবারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রফিকসহ ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে পুলিশসহ ৫’শ-৬’শ জন অজ্ঞাত দেখিয়ে আরেকটি মামলা করেন।
পরে হাইকোর্ট মামলা দুটি এক করে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন। ২০১৯ সালের ২৩ জুলাই তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) গাইবান্ধা ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আবদুল হাই সাঁওতাল হত্যা মামলার চূড়ান্ত অভিযোগপত্র গোবিন্দগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জমা দেন। এই মামলার গুরত্বপূর্ণ ১১ আসামির নাম বাদ দিয়ে ৯০ জনের নামে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
মামলায় ২৫ আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। উদ্ধার করা হয় লুট হওয়া একটি পাওয়ার টিলার, দুটি শ্যালো মেশিন, একটি ভ্যান ও ৫৬টি ঢেউটিন। আসামিদের মধ্যে গোবিন্দগঞ্জের সারাই গ্রামের শাহজাহান আলীর ছেলে মিঠু মিয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন আদালতে।
পরবর্তীতে হাইকোর্টের নির্দেশে মামলা দুইটি তদন্ত করে পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন)। ২০১৯ সালের ২৩ জুলাই পিবিআই গাইবান্ধা ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তৎকালীন সহকারি পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আবদুল হাই সাঁওতাল হত্যা মামলার চুড়ান্ত গোবিন্দগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল আদালতে গুরত্বপুর্ণ ১১ জন আসামির নাম বাদ দিয়ে ৯০ জনের নামে অভিযোগপত্র জমা দেন। 
এই মামলার প্রধান আসামি এমপি আবুল কালাম আজাদসহ প্রকৃত দোষীদের বাদ দেয়ার অভিযোগ এনে সেই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে ওই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর আদালতে নারাজি পিটিশন করেন মামলার বাদী থমাস হেমব্রম। আদালত শুনানী শেষে ওই বছরের (২০১৯ সাল) ২৩ ডিসেম্বর গোবিন্দগঞ্জ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক পার্থ ভদ্র অধিকতর তদন্ত করতে (ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনকে (সিআইডি) নির্দেশ দেন। সিআইডি ২০২০ সালের ২ নভেম্বর আদালতে একই ধরণের অভিযোগপত্র দাখিল করে। ২০২০ সালে বছরের ৪ জানুয়ারি বাদি থোমাস হেমব্রম পুনরায় নারাজি করেন। এ নারাজির উপর একই বছরের  ১২ সেপ্টেম্বর শুনানী করে আদালত। সেই বছরের ৭ ডিসেম্বর নারাজির শুনানী হয়ে এ মামলায় কয়েকটি শুনানী হয়। সর্বশেষ চলতি বছরের ৪ সেপ্টেম্বর নারাজীর শুনানি হয়। আবারও আগামি বছরের ১২ মার্চে পরবর্তী নারাজী শুনানির দিন ধার্য্য করে করেন আদালতের বিচারক নাজমুল হাসান।
বাদি পক্ষের আইনজীবি মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ২০২৪ সালের ১২ মার্চ নারাজি শুনানীর উপর আদেশ হবার কথা আছে। পিবিআই ও সিআইডি উভয় অভিযোগপত্রে মুল আসামিসহ ১১জনের নাম বাদ দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। এ মামলায় দীর্ঘদিন  কয়েকটি শুনানি হয়েছে। এতে চরম হতাশ হয়ে পড়েছেন সাওতালরা।
সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাক্সে বলেন, সাত বছর আগে উচ্ছেদের নামে সাঁওতালদের ওপর হামলা, বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ এবং বর্বরোচিতভাবে গুলিবর্ষণ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসময় তিনজন সাওতাল নিহত ও কয়েকজন আহত হয়।এ ঘটনার সাত বছর পেরিয়ে গেলেও মামলার উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। নির্যাতনের শিকার সাঁওতালরা মানবেতর জীবন-যাপন করছে। সেই সময় সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাসের বানী শোনালেও তার কোনোটি বাস্তবায়ন হয়নি। গোবিন্দগঞ্জ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক নাজমুল হাসান চলতি বছরের ৪ সেপ্টেম্বর শুনানি শেষে দীর্ঘ সাড়ে ছয় মাস পর আবারও আদেশের দিন ধার্য্য করেছেন। এই দীঘসূত্রিতায় আমরা হতাশ।
এসএসএস

আরও খবর

Sponsered content